১.পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন – রোজার উৎপত্তি এবং ফজিলত
৩. পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন – রমজান মাসে কোন কোন ক্ষেত্রে রোজা না রেখে পরবর্তী সময়ে কাজা এবং ফিদিয়া আদায় করতে হয়
মেরু অঞ্চল সমুহে রোজা রাখার নিয়ম সম্পর্কে যদিও ইসলামিক বিধানে স্পষ্ট কোন বিধান পাওয়া যায়না, তবে অধিকাংশ ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে রোজা ও নামাজ সমুহ সূর্য উদয় ও গভীর রাত হবার হিসাবেই সম্পন্ন করতে হবে। অর্থাৎ রোজা রাখার সময়কে ২৪ ঘণ্টার ভিতরেই সম্পন্ন করতে হবে।
এই সমস্যার কারণ হলো গ্রীষ্ম কালে মেরু অঞ্চলে অর্থাৎ অক্ষাংশে নিশীথে সূর্য অর্থাৎ গভীর রাতেও সূর্য দেখা যায় এবং শীত কালে ঠিক উল্টাটা হয়। সহজ বাংলায় বলতে হয় যে, মেরু অঞ্চলে ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত্রি থাকে। এই প্রাকৃতিক ঘটনাটি সংঘটিত হয় কারণ হল এই যে, গ্রীষ্ম কালে পৃথিবীর অক্ষাংশ সূর্যের দিকে হেলে থাকে এবং শীতকালে সূর্য থেকে দূরে সরে যাবার কারণে অঞ্চল সমূহে ছয় মাস যাবৎ টানা সূর্যের আলো দেখা যায়।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের আদি মুসলমানরা মেরু অঞ্চলে বসবাস করতেন না, তারা উপক্রান্তিয় অঞ্চলে বসবাস করতেন যেখানে সূর্য দিনের বেলায় সরাসরি উপরি ভাগে থাকে এবং রাতে অস্ত যায়। এজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের এই ঘটনা গুলির অভিজ্ঞতা হয়নি।
মহান আল্লাহতায়ালা সব মুসলমানদের ওপর নামাজ রোজা ফরজ করেছেন। পৃথিবীর যেসব দেশে স্বাভাবিক রাত-দিন দান করেছেন সে সব দেশে তো নামাজ রোজার সময় নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না।
তবে মেরু অঞ্চলের দেশ সমূহ- যাতে বছরের বিভিন্ন সময়ে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত দিন থাকে, সেখানে রাতের নামাজসমূহ ও দিনে রোজা আদায় নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড সহ বেশ কিছু দেশে বছরের কোনো কোনো সময়ে ইফতারের সময় হওয়ার কিছুক্ষণ পরে এশার সময় আসার পূর্বেই পুনরায় ফজরের সময় হয়ে যায়। এ জন্য ওই সব দেশ সমূহের নামাজ রোজার বিধান নিয়ে আলেমরা গবেষণা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
মাসয়ালা (১) – অনেক আলেম এসব এলাকার মানুষদের ওপর ওই ওয়াক্তের নামাজ রোজার বিধান নেই বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু অধিকাংশ ফকিহ ও আলেম এসব এলাকার মুসলমানদের নামাজ রোজার সব বিধান বলবৎ থাকার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তবে তা আদায়ের নিয়মের মধ্যে কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে।
(হাশিয়াতুত তাহতাবি আলাল মারাকি: পৃঃ ১৭৮, রদ্দুল মুহতার: ১/৩৬২)
মাসয়ালা (২) – যে সমস্ত ফকিহ ও বিশেষজ্ঞ ওই সব এলাকায়ও নামাজ রোজার বিধান বলবৎ থাকার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সে সব আলেম তাদের সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। হাদিসটা হচ্ছে-
হজরত নাউয়াস ইবনে সামআনের (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দাজ্জালের আবির্ভাব ও সে সময়ের ফেতনা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। বর্ণনার এক পর্যায়ে সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দাজ্জাল পৃথিবীতে কতদিন অবস্থান করবে? হজরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, চল্লিশ দিন অবস্থান করবে, এর প্রথম দিন এক বছর সমপরিমাণ, দ্বিতীয় দিন এক মাস সমপরিমাণ এবং তৃতীয় দিন এক সপ্তাহ সমপরিমাণ, আর বাকী দিনগুলো সাধারণ দিন সমূহের ন্যায়। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এক বছর সম পরিমাণ দিনে কি আমাদের এক রাত-দিনের পরিমাণ অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেই কি যথেষ্ট হবে ? হরজত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, না, বরং তা সময় হিসাব করে পূর্ণ এক বছরের নামাজই আদায় করতে হবে।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৩৭, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৩২১)
মাসয়ালা (৩) – যদি এমন হয় যে, দিন বড় হলেও সাহরি ইফতারি ও সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অল্প সময়ের জন্য হলেও নিয়ম মাফিক হয়ে থাকে তাহলে এর বিধান সাধারণ এলাকা সমূহের ন্যায়ই হবে। হ্যাঁ, যদি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উক্ত নিয়ম মাফিক হয়েও দিন অস্বাভাবিক বড় হয়ে যাওয়ার করণে রোজা রাখতে কঠিন সমস্যা হয় তাহলে শরিয়তে তাদেরকে রোজা ভেঙ্গে পরবর্তি স্বাভাবিক দিনে সেগুলো কাজা করে নেওয়ার সুযাগ দেয়।
(রদ্দুল মুহতার: ১/৩৩৯, ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া: ৪/১৪৫)
মাসয়ালা (৪) – যদি লাগাতার কয়েক দিন সূর্য অস্ত না যায়, তাহলে ২৪ ঘন্টা করে সময় ভাগ করে প্রথম ১২ ঘন্টাকে রাত ধরে দ্বিতীয় ১২ ঘন্টা শুরু হওয়ার দেড় ঘন্টা পূর্বে সাহরি খেয়ে শেষ করে রোজার নিয়ত করে রোজা আরম্ভ করে দিবে। দ্বিতীয় ১২ ঘন্টা শেষ হলে ইফতার করে মাগরিব এশা তারাবিহ নামাজ সব পড়ে নিবে।
(রদ্দুল মুহতার: ১/৩৩৯, ফাতাওয়ায়ে ফরিদিয়া: ৪/৯৮)
মাসয়ালা (৫) – আর যদি ২৪ ঘন্টায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হলেও নিয়ম মাফিক না হয়, বরং সূর্যাস্তের পর ইফতার ও সাহরির সময় না পেতেই ফজরের সময় ও সূর্যোদয় হয়ে যায় তাহলে উলামায়ে কেরাম তাদের নামাজ-রোজা আদায়ের দু’টি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন-
এক ) সে সব এলাকার লোকেরা প্রতি চব্বিশ ঘন্টা সময় হিসেব করে তা ভাগ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, চাই পূর্ণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় পাওয়া যাক বা না যাক। রোজার ক্ষেত্রে তারা সেখানে ২৪ ঘন্টা পূর্ণ হওয়ার এতটুকু সময় পূর্বে ইফতার করে নিবে যেটুকু সময় জরুরত পরিমাণ খানা-পিনা করতে পারবে। এরপর তারা রোজার নিয়ত করে খানা-পিনা বন্ধ করে দিবে। তবে এক্ষেত্রেও এভাবে তাদের রোজা আদায় কঠিন ও কষ্টকর হলে ওই সময় না রেখে পরবর্তিতে কাজা করে নিতে পারবে। এ জন্য রোজা কাজা হলে গুনাহ হবে না। আর মাগরিব এশা ও বিতির নামাজ যথাক্রমে পড়ে নিবে। তারবির সময় না পাওয়া যাওয়ায় তা না পড়লেও চলবে।
(ফাতহুল কদির: ১/১৫৬, রদ্দুল মুহতার: ২/৪২০, আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৭১)
দুই ) তারা ওই দেশের পার্শ্ববর্তী নিকটতম দেশ যেখানে নিয়মিত সূর্য উদয়-অস্ত হয়, সেখানের নামাজ-রোজার সময় অনুযায়ী নিজ দেশে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং প্রতিদিনের রোজা আদায় করবে।
(ইমদাদুল ফাতাওয়া: ১/১৭৩, তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম: ৬/৩৭৬-৩৭৮)
(রমজান সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য আসবে আগামী পর্বে )
সম্পাদনা – সিকদার হেফাজত উল্লাহ