১.পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন – রোজার উৎপত্তি এবং ফজিলত
৩. পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন – রমজান মাসে কোন কোন ক্ষেত্রে রোজা না রেখে পরবর্তী সময়ে কাজা এবং ফিদিয়া আদায় করতে হয়
৪. পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন – মেরু অঞ্চলের দেশসমূহে নামাজ – রোজার বিধান
রোজা রাখার উদ্দেশ্য-
রোজা রাখার মুল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। রোজা মানুষকে শারীরিক ও আধ্যাত্মিক ভাবে সুস্থ করে তোলে। সংযমের কারণে শরীরে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে এবং অন্তর পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে এবং নিজেদের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরহেজগারি বা তাকওয়া বৃদ্ধি করে। রোজা রাখার বিষয়ে আল্লাহ তাগিদ দিয়েছেন।
কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,
হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।
(সুরা বাকারা ১৮৩) আল-বায়ান
রমযান মাস চলাকালীন যদি কেউ অসুস্থতা বা সফরে থাকার কাজে রোজা রাখতে সক্ষম না হন, সেক্ষেত্রে তার করনীয় কি হবে ? এ বিষয়েও আল্লাহ স্পষ্ট বিধান দিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেছেন,
নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান।
(সুরা বাকারা ১৮৪) আল-বায়ান
আল্লাহ আরও বলেন যে,
রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াত স্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী রূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।
(সুরা বাকারা ১৮৫) আল-বায়ান
এই ‘ তাকওয়া ’ শব্দটি কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে অর্থ করেছেন। তবে অধিকাংশের মতেই এর অর্থ হবে “ আল্লাহ ভীতি । ” অনেকেই বলেন যে, তাকওয়া শব্দের মূল অর্থ হবে ‘রক্ষা করা।’ অর্থাৎ এর অনুবাদ করা হয়েছে নানা ভাবে। যেমন – পরহেজগারি, আল্লাহর ভয়, দ্বীনদারি, সৎ কর্মশীলতা, সতর্কতা ইত্যাদি। রোজা মুমিনের ঢালের মতো কাজ করে তাঁকে গোনাহের হাত থেকে বাঁচায়।
রোজার বিধান –
রোজার সময় কতক্ষন সংযম রক্ষা করতে হবে ? অর্থাৎ কখন সেহেরির শেষ সময় বা কখন ইফতারের সময় বিষয়েও আল্লাহ স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেছেন,
সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের নিকট গমন হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছদ। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা নিজদের সাথে খিয়ানত করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবূল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন। অতএব, এখন তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা অনুসন্ধান কর। আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর। আর তোমরা মাসজিদে ইতিকাফ রত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না। এটা আল্লাহর সীমারেখা, সুতরাং তোমরা তার নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবেই আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ মানুষের জন্য স্পষ্ট করেন যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে।
(সুরা বাকারা ১৮৭) আল-বায়ান
রমযান মাসের উপকারিতা–
রমযান মাসের একটি বিশেষ ফজিলত বা মাহাত্ম্য হচ্ছে যে, এই পবিত্র রমজান মাসেই আল কোরআন নাযিল হওয়া শুরু হওয়ার ফলে আমরা একটি পুরনাঙ্গ জীবন বিধান পেয়ে নিজেদের দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের চাবিকাঠি পেয়ে যাই। এছাড়াও রমজান মাসের রোজা রাখা বা সংযম পালন করার আরও বহুবিদ উপকারিতা আছে। রমজান মাসের রোজা বা সংযমের শিক্ষা মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দেয়, মানুষের কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে, এবং আত্মাকে দহন করে ঈমানের শাখা প্রশাখা সঞ্জিবীত করে। এছাড়াও চিকিৎসা বিজ্ঞান এই উপবাস ও সংযমের ফলে মানুষের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যর উন্নয়ন বিষয়ে অনেক গুরুত্ব পূর্ণ তথ্য দিচ্ছে। সর্বোপরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভেরও একটি গুরুত্ব পূর্ণ উপাদান হিসাবে গ্রহন করা যায়।
এই মর্মে মহানবী (সাঃ) বলেছেন,
” রোজাদারদর জন্য দুটি খুশির সময়ের একটি হলো তার ইফতারের সময়, আর অন্যটি হলো তার আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের (সালাত আদায়ের) সময়।”
(বুখারী ও মুসলিম)
বিভিন্ন ধর্মে রোজা-
রোজাও নামাজের মতোই একটি পুরোনো ইবাদত এবং পূর্ববর্তী বিভিন্ন ধর্মে রোজা রাখার বিধান রাখা হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, চীন, জাপান, কোরিয়া, মিসর ও গ্রিসে রোজার প্রচলন ছিল। মূসা (আঃ) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছ থেকে তাওরাত প্রাপ্তির আগে ৪০ দিন সংযম পালন করেন। ঈসা (আঃ) তাঁর ধর্ম প্রচারের শুরুতে ইঞ্জিল পাওয়ার আগে ৪০ দিন রোজা রেখেছিলেন।
ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের জন্য রোজা পালনের বিধান ছিল। ইহুদিদের ওপর প্রতি শনিবার বছরের মধ্যে মহররমের ১০ তারিখে আশুরার দিন এবং অন্যান্য সময় রোজা ফরজ ছিল। খ্রিষ্টানদের ওপর মুসলমানদের মতোই রোজা ফরজ ছিল। বাইবেলে রোজা ব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার মধ্যেই রোজা পালনের ইতিহাস পাওয়া যায়।
আমরা জানি যে, লাইলাতুল কদরে বা কদরের রাত্রিতে কোরআন নাযিল হওয়া শুরু হয়। ঐ রাতে হেরা গুহাতে সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নাযিল হয়। বলা হয়েছে যে, রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাত্রির কোনো এক রাত্রি এই শবে কদর। যদিও অধিকাংশের মতে সেটা রমযান মাসের ২৭ তারিখই ধরে নেয়া হয়। যদিও আরেক মতে সেটি ২৩তম রাত্রি। তবে নিশ্চিতভাবে এই রাতটি পাবার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ ইতিকাফ করে থাকেন, অর্থাৎ নির্জনে টানা ১০ দিন ইবাদত। আর এই রমজান শেষ হওয়া মানেই ঈদুল ফিতর যা মুসলিমদের প্রধান দুটি উৎসবের একটি।
পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও, মতবাদ প্রচলিত আছে যে, নবী ইব্রাহিমের (আঃ)সহিফা নাজিল হয়েছিল তৎকালীন রমজানের ১ম দিবসে, তাওরাত নাযিল হয়েছিল ৬ রমজান, যাবুর ১২ রমজান আর ইঞ্জিল ১৩ রমজান। যদিও আরবের বাহিরে রমজান মাস হিসেব করা হতো না, কিন্তু এই হিসেবটা ভিন্ন জাতিক পঞ্জিকার সঙ্গে মিলিয়ে স্থির করা হয়েছে বলে বলা হয়।
তবে পুরো এক মাস পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার আদেশ অবতীর্ণ হয় যখন মোহাম্মাদের (সাঃ)সাহাবিরা মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরত করেন তার পরে। সেটা ছিল হিজরতেরও ১৮ মাস পরের ঘটনা। তখন আরবি শাবান মাস চলছিল।
আল্লাহ বলেছেন,
রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াত স্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী রূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।
(সুরা বাকারা ১৮৫) আল-বায়ান
মুসলমানদের আগেও মানুষ রোজা রাখতো-
তবে এমন না যে, এর আগে কেউ রোজা রাখত না। অবশ্যই রাখত। কোরআনেই বলা রয়েছে যে, আগের জাতিগুলোর জন্যও রোজা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, সেটা রমজান না হলেও। এমনকি মক্কার মানুষেরাও ইসলামের পূর্বে রোজা রাখত, তবে সেটা কেবল মুহাররাম মাসের ১০ম দিন, আশুরার রোজা। কারবালার ঘটনা তখনো ঘটেনি, আশুরার প্রধান উপজীব্য ছিল মুসার (আঃ) নেতৃত্বে মিসর থেকে বনি ইসরাইলের মুক্তি এবং লোহিত সাগর দু’ভাগ হয়ে যাবার ঘটনা। আত্মসংযম আর আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে অন্যরাও রোজা রাখত বটে।
আল্লাহ বলেন,
হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।
(সুরা বাকারা ১৮৩) আল-বায়ান
৭৪৭ সালের একজন আরব লেখক আবু যানাদ জানান যে, উত্তর ইরাকের আল জাজিরা অঞ্চলে অন্তত একটি মান্দাইন সমাজ ইসলাম গ্রহণের আগেও রমজানে রোজা রাখত। প্রথম থেকেই রমজানের রোজা রাখা শুরু হত নতুন চাঁদ দেখবার মাধ্যমে, তাই অঞ্চল ভেদে রোজার শুরুও ভিন্ন হতো। এখন মেরু অঞ্চলের কাছা কাছি দেশের মুসলিমরা প্রকৃতির স্বাভাবিক সময়ানুসারে সেখানে রোজা রাখতে পারে না, যেহেতু সেখানে দিন রাত্রির পার্থক্য করা দুরূহ। তাই নিকটতম স্বাভাবিক দেশের সময় সূচি কিংবা মক্কার সময় মেনে তারা রোজা রাখে এবং ভাঙে।
আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (সাঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সব সময় রোজা রাখ এবং রাত ভর নামাজ আদায় কর। এহেন অবস্থা হতে রোজাকে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং এক আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানোর নিমিত্তে মহান রাব্বুল আলামিন দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজাকে এ উম্মাতের ওপর ফরজ করে দেন।
উম্মতে মোহাম্মদিয়ার মধ্যে নবীজির (সাঃ) ও খোলাফায়ে রাসেদার সময়ের মতন মুসলমানদের মাথার উপড়ে একজন ওয়াজেবুল এতায়াত ইমাম বা সর্বজন মান্য নেতা না থাকাতে ঈমান ও আমলের কোন বিষয়েই মুসলমানেরা একমত হতে পারছেনা। আলেম ওলেমা শায়খ পীর ইমাম ইত্যাদির কেউই ঈমান ও আমলের বিষয়ে ভিন্ন মতের কাউকেই মানতে রাজি নয় বলেই উম্মতে এতো বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই এই প্রতিবেদন লেখা হল যেন প্রত্যেকেই যেন মাতৃভাষায় কোরআনের অনুবাদ পড়ে নিজেদের বিবেক ও বুদ্ধি খাটিয়ে প্রকৃত সত্য জানতে ও মানতে পারে।
আল্লাহ সবাইকে সত্য জানতে বুঝতে ও মানতে সহায়তা করেন। আমীন।
সম্পাদনা – সিকদার হেফাজত উল্লাহ