রোযা বা রোজা,  সাউম, স্বাউম্‌, বা সাওমের আরবি থেকে বাংলা সহজ অর্থঃ সংযম।  সিয়াম হল ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ। সুবহে সাদেক বা ভোরের সূক্ষ আলো থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার বা সংযম করার নামই হল রোযা। ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মুসলমানের জন্য চান্দ্রবর্ষের রমযান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ/ফার্দ্ব্‌ যার সহজ অর্থ হল বাধ্যতা মুলক বা অবশ্য পালনীয়।

কিছু মুসলিম আলেম রমযান মাসের রোজা রাখার ক্ষেত্রে ফার্সি শব্দ “ রোজা ”র  পরিবর্তে মুল আরবী শব্দ ” সাওম ” বা সিয়ামের ব্যবহারকেই বেশী গুরুত্ব দিয়ে উৎসাহিত করে থাকেন। যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, সাওম শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই শব্দটি ওভাবেই বলা উচিৎ।

রোজা অনেক ধর্মেরই একটি অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্ম। রোজা রাখার নিয়ম সর্বযুগেই প্রচলিত ছিল। আদি মানব সর্ব প্রথম নবী আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নবী ও রসুল মোহাম্মদ (সাঃ)) পর্যন্ত নবী-রাসুলগণ রোজা পালন করেছেন।

আদম (আঃ) থেকে নূহ (আঃ) পর্যন্ত প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা ফরজ ছিল, যাকে ‘ আইয়্যামে বিজ ’ বলা হতো। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোজা রাখার বিধান ছিল। পরে দ্বিতীয় হিজরি সালে উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর মাহে রমজানের রোজা ফরজ হলে তা রহিত হয়ে যায়।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মদিনায় আগমন করে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিন সাওম পালন করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কি ? তোমরা এই দিনে সাওম পালন কর কেন ? তারা বলল,  এ অতি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ বনি ইসরাইলকে শত্রুর কবল থেকে নাজাত দান করেছেন। তাই মূসা (আঃ) এ দিনে সাওম পালন করেছেন। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার (আঃ) অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিন সাওম পালন করেন এবং সবাইকে সাওম পালনের নির্দেশ দেন।

রমযান মাসের রোজার উৎপত্তি : কোরানিক পরিভাষায় আরবিতে ইসলামী উপবাসের নাম সাওম, যা বহুবচনে সিয়াম, যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে “ সংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণ বা বিরত থাকা।”

রোজা শব্দটি ফারসি শব্দ, যা এসেছে আদি-ইরানীয় ধাতুমূল রোওচাকাহ থেকে, যার অর্থ উপবাস, যা আবার এসেছে মুলতঃ ইন্দো-ইরানীয় ধাতুমূল “ রোচস ” থেকে, যার অর্থ দিন বা আলো।

ফারসি ভাষায় সিয়ামের প্রতিশব্দ হিসেবে রোজা ব্যবহৃত হয়,  যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ভাষার মত কাল ক্রমে বাংলা ভাষাতেও শত শত বছর আগে থেকে এখন পর্যন্ত সাওম বা সিয়াম নামক ইসলামী উপবাস বোঝানোর জন্য সমধিক ভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার, কামাচার, পাপাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস ও অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা।

রোজার ফযিলত – আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ , হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন, “ ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় যে ব্যক্তি রোযা পালন করে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়।”

আবূ হুরাইরাহ্‌ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, , রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “ শয়তান ও দুষ্ট জিনদেরকে রামাযান মাসের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের দরজা গুলো বন্ধ করা হয় এবং এর দরজাও তখন আর খোলা হয় না, খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজা গুলো এবং এর একটি দরজাও তখন আর বন্ধ করা হয় না। এ মাসে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেনঃ হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত! বিরত হও। আর বহু লোককে আল্লাহ্র পক্ষ হতে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক রাতেই এরূপ হতে থাকে।”

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “ আল্লাহর মর্জি হলে আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকাজের প্রতিদান দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আল্লাহ্ বলেনঃ তবে রোযা ব্যতীত, তা আমার জন্যই (রাখা হয়) এবং আমিই তার প্রতিদান দিবো। সে তার প্রবৃত্তি ও পানাহার আমার জন্যই ত্যাগ করে। রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দঃ একটি আনন্দ তার ইফতারের সময় এবং আরেকটি আনন্দ রয়েছে তার প্রভু আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাতের সময়। রোযাদার ব্যক্তির মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট কস্তুরীর ঘ্রাণের চেয়েও অধিক সুগন্ধময়।”

আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “ সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য শাফা‘আত করবে। সিয়াম বলবে, হে রব! আমি তাকে দিনে খাবার গ্রহণ করতে ও প্রবৃত্তির তাড়না মিটাতে বাধা দিয়েছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার শাফা‘আত কবূল করো। কুরআন বলবে, হে রব! আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবূল করা হবে।”

রমজান সম্পর্কিত পরের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন – রোজার ইতিহাস, রোজার ফরজ শর্তাবলী, প্রকারভেদ এবং রোজা ভঙ্গ হলে করনীয়

সম্পাদনায় – সিকদার হেফাজত উল্লাহ